বাঙ্গালা ভাষার চর্চা আমাদের ভবিষ্যৎ মঙ্গলের জন্য অপরিহার্য। তবে মাতৃভাষা আমাদের হাতে কি রূপ পরিগ্রহণ করবে তা নিয়ে মতভেদ দেখতে পাওয়া যায়। এ সমস্যার সমাধান “আমরা বাঙ্গালী মুসলমান” এই কথাটুকুর মধ্যেই রয়েছে। কোটি কোটি মানুষের স্বাভাবিক ভাষা যদি একটা সাহিত্যের বাহন না হয়, তা হলে কোন ভাষা যে, সে গৌরবের অধিকারী তা বলতে পারি না।
ভাষার আকার-প্রকার এবং জাতি বিচার নিয়ে হিন্দু এবং মোসলেম সাহিত্যিকের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদের সৃষ্টি হয়েছে। পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পূর্বে হিন্দু এবং মুসলমান উভয় শ্রেণীর সাহিত্যিকেরাই অসংখ্য আরবী, ফার্সী এবং উর্দু শব্দ বাঙ্গালা ভাষায় ব্যবহার করতেন পরিপূর্ণ মনের ভাব অভিব্যক্ত করার জন্য। সাহিত্যের ভাষা কিন্তু বিদ্যাসাগর মহাশয় একেবারে বদলে দিয়েছেন। তিনি আরবী, ফার্সী এবং উর্দু শব্দসমূহকে সম্পূর্ণরূপে বর্জন করে, তাদের জায়গায় সংস্কৃতমূলক শব্দের আমদানী করেছেন। ফলে পণ্ডিতি বাঙ্গালা তথা বর্তমান বাঙ্গালা হিন্দু-সাহিত্যের সৃষ্টি হয়েছে। বিদ্যাসাগরের মত স্বজাতি প্রেমিক কোন মনীষী যদি আমাদের সমাজে থাকতেন, তা হলে তাঁর প্রচেষ্টায় আমাদের সেই প্রাচীন সাহিত্যও নতুন রূপ পরিগ্রহণ করতো এবং যথাসময়ে বর্তমান কালোপযোগী ভাব এবং চিন্তার উপযোগী বাহন হয়ে দাঁড়াত। দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উদ্দু এবং ফার্সীর মোহেই তখন মেতে রইলেন, মাতৃভাষার দিকে ভ্রূক্ষেপমাত্র করলেন না। আমাদের জাতীয় সাহিত্য তাই নতুন যুগের উপযোগী হয়ে উঠতে পারলো না, লাঞ্ছিত, অনাদৃত হয়ে সে পল্লীর কুটিরেই পড়ে রইলো। পক্ষান্তরে হিন্দুদের জাতীয় সাহিত্য তাদের অক্লান্ত সেবায় সমৃদ্ধ এক সাহিত্যে পরিণত হল। তারপর দুই-একজন করে মুসলমানেরা যখন বাঙ্গালা সাহিত্যের আসরে নামতে আরম্ভ করলেন, তখন হিন্দুর ব্যবহৃত বাঙ্গালা ভাষা সমস্ত শিক্ষায়তনগুলিকে দখল করে বসেছে, দেশের সাহিত্যকে দখল করে বসেছে, সংবাদপত্র প্রভৃতিকে দখল করে বসেছে। জাতীয় ভাষা ব্যবহার করার মত সাহস, শক্তি এবং প্রতিভা আমাদের তখনকার সাহিত্যিকদের মধ্যে ছিল না। হিন্দুর ব্যবহৃত ভাষাকেই তাঁরা রুচিসম্মত এবং ভদ্রতাসম্মত বলে মনে করলেন। মীর মশাররফ হোসেন, মুন্সী রেয়াজুদ্দীন, শেখ আবদুর রহিম প্রভৃতি হচ্ছেন সেই যুগের লব্ধ প্রতিষ্ঠিত মুসলমান সাহিত্যিক। তারপর এসেছে আমাদের এই বর্তমান যুগ। বিদ্যাসাগরী গোড়ামীর বিরুদ্ধে এবং মীর মশাররফ হোসেন প্রমুখ সাহিত্যিকদের অন্ধ অনুকরণপ্রিয়তার বিরুদ্ধে এক স্বাভাবিক বিদ্রোহ বা Natural reaction দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিকালে ‘সওগাতক প্রকাশিত “বাঙ্গালা ভাষায় মুসলমানী শব্দ”, “মুসলমানের ভাষা ও সাহিত্য” প্রভৃতি প্রবন্ধই তাঁর উৎকৃষ্ট প্রমাণ। আমরা আস্তে আস্তে এখন বুঝতে পারছি, প্রজাদের স্বাভাবিক জাতীয় ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি করা লজ্জার বিষয় নয়, উপরন্তু সেই ভাষাতেই আমাদের প্রকৃত সাহিত্য আত্মপ্রকাশ করতে পারে। আমাদের স্বাভাবিক ভাষা কী? বাঙ্গালী মুসলমানের বাঙ্গালা যে বাঙ্গালী হিন্দুর বাঙ্গালা থেকে অনেকাংশে ভিন্ন, সে বিষয়ে সন্দেহ মাত্র নেই। আর এই প্রভেদ অহেতুক নয়। এর যথেষ্ট ঐতিহাসিক এবং কালচারগত কারণ বর্তমান আছে। সেই সব কারণের দরুন এক সময় পুঁথির ভাষা স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করেছিল। অবশ্য এখন আমাদের ভাষাকে অনেকটা সহজবোধ্য করতে হবে। আমির হামজার দাস্তানের ভাষা আমাদের সাহিত্যে আর চলবে না। আমরা আমাদের স্বাভাবিক ভাষার অনুকরণ করে সরলতার পথে অগ্রসর হব। পরে হয়তো হিন্দু ও মুসলমানের দুই উপভাষায় মিলে ব্যাপকতর এক ভাষার সৃষ্টি করবে। তবে সে পরিণতি নির্ভর করবে আমাদের হিন্দু বন্ধুদের উপর, কেননা তাঁদের উপভাষা গ্রহণে এক্ষণে আমরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত অগ্রসর হয়েছি। তাঁরা এখন এগিয়ে অর্ধপথে এসে আমাদের সঙ্গে মিলিত হবে। সাহিত্যে কাজ হচ্ছে ব্যক্তির, জাতির, বিশ্বমানবের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, বেদনা-সমবেদনা প্রভৃতি অনুভূতিকে, মানুষের অন্তরের অন্তরতম সত্যকে, সুন্দর-সরল মর্মস্পর্শী ভাষায় প্রকাশ করা। তবে প্রত্যেক দেশের, প্রত্যেক জাতির এবং প্রত্যেক যুগের সাহিত্যের দেশগত, জাতিগত, যুগগত, বৈশিষ্ট্য বর্তমান আছে। প্রত্যেক জাতির মধ্যে এবং প্রত্যেক সমাজের মধ্যে এইসব বিশেষত্ব আবহমানকাল থেকে চলে আসছে।
বিশ্বমানবতার বড় সমর্থক হচ্ছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিশ্বমানবতার বিষয় নিয়ে যত লিখেছেন, আর কেউ বোধ হয় তত লেখেন নি। তাঁরই লেখা পড়ে এবং বক্তৃতা শুনে একদল দেশপ্রেমিক আমাদের সাহিত্যিকদের মধ্যে দেখা দিয়েছেন, আর তাঁরা ইসলামী সভ্যতাকে বাঙ্গালা দেশ থেকে তাড়াবার জন্য বন্ধপরিকর হয়েছেন এবং হিন্দু ও মোসলেম সভ্যতার সমন্বয় করে নতুন একটা কিছু গড়বার চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করেছেন। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, রবীন্দ্রনাথের প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁরা এ সব করছেন, তিনি অশেষ কষ্ট করে ভারতবর্ষ থেকে বড় বড় পণ্ডিত সঙ্গে নিয়ে ক্ষুদ্র বালী দ্বীপে যাচ্ছেন হিন্দু কালচারের পুনরুত্থানের জন্য; নটরাজের পালা লিখছেন, বাঙ্গালী ছেলেদের হিন্দু পৌত্তলিকতার আধ্যাত্মিকতা শেখাবার জন্য বেদমন্ত্র পাঠে ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথের জন্মতিথি উৎসব সম্পন্ন হচ্ছে প্রাচীন হিন্দু আদর্শকে জাগিয়ে রাখবার জন্য। যে রবীন্দ্রনাথ একটি প্রবন্ধ লিখলে দশবার তাতে উপনিষদের উল্লেখ করতে ছাড়েন না, তাঁরই নির্দেশিত পথের অনুসরণ করে আমাদের সমাজের কতিপয় সাহিত্যিক ইসলামিক কালচারের শত্রুতা সাধনে আত্মনিয়োগ করেছেন। একেই বলে অদৃষ্টের পরিহাস! এই সেইদিন মহাত্মা গান্ধী বলেছেন, আত্মনিয়ন্ত্রণশীল ভারতে, মিশনারীদের তিনি খৃষ্টান ধর্ম প্রচার করতে দেবেন না। কারণ, তাঁদের নিজস্ব ধর্মবাদই ভারতবাসীর পক্ষে যথেষ্ট। হিন্দুরা তাঁদের জাতীয় কালচারের প্রয়োজন কতটা অনুভব করেন, রবীন্দ্রনাথের এবং মহাত্মা গান্ধীর সাধনা এবং উক্তি থেকে তা স্পষ্ট বোঝা যায়। হিন্দু সভ্যতা এবং স্বাধীনতার পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন বঙ্কিমচন্দ্র দেখেছিলেন। সে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়িত করবার জন্য আজ সমস্ত হিন্দু সমাজ উঠে পড়ে লেগেছেন। হিন্দু যে ভবিষ্যৎ ভারতীয় কালচারের স্বপ্ন দেখেন, তা লুপ্ত হিন্দু সভ্যতার দ্বিতীয় সংস্কারণ ছাড়া আর কিছু নহে।
জাতীয় জীবনের সঙ্গে জাতির কালচারের ঠিক সেই রকম সম্বন্ধ, যেমন শরীরের সঙ্গে প্রাণের। যতদিন জাতীয় কালচার বর্তমান আছে, ততদিন জাতির মৃত্যু নেই। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, জাতীয় কালচারের সাহায্যেই জাতি সমস্ত বিপদ-আপদ অতিক্রম করে সিদ্ধির, মুক্তির উদার আকাশতলে এসে দাঁড়ায়।
বিপদের ঘনঘটায় জীবন আমাদের আচ্ছন্ন। আমাদের ভবিষ্যৎ যে বর্তমানের চেয়ে অনেক বেশী বিপদসঙ্কুল হবে, স্পষ্টই তা বোঝা যায়। সেই দুর্দিনে স্বতন্ত্র নির্বাচন আমাদের বাঁচাবে না আর মিশ্র নির্বাচনও আমাদের বাঁচাবে না। আমাদের কালচারকে যদি আঁকড়ে ধরে থাকি, সেই কালচারের যদি উপযুক্ত সম্মান এবং সমাদর করি, তাহলে সেই কালচারই আমাদের তখন একমাত্র রক্ষাকবচ হবে, আর সেই কালচারের সাহায্যেই আমাদের সমাজ-তরণী বিপদের উত্তাল তরঙ্গ-মালা অতিক্রম করে সালামতের বন্দরে পৌঁছতে পারে।
আমাদের জীবনের প্রতি লক্ষ্য করলে তিনটি সত্য একান্ত স্পষ্ট হয়ে আমাদের চোখের সামনে ধরা দেয়, যথা: ১. আমরা ধর্মে, কালচারে এবং রক্তে মুসলমান ২. রাষ্ট্রে এবং ভৌগোলিক বিভাগ হিসাবে আমরা ভারতবাসী ৩. মাটি, ভাষা, স্বাভাবিক সহানুভূতি হিসাবে আমরা বাঙ্গালী। এই তিনটি বড় সত্য আমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করছে। এর কোনটিকে অবহেলা করে কিছু সমাধান করলে তা আমাদের সমস্যার নিষ্পত্তি করবে না, আমাদের প্রাণে প্রেরণার সঞ্চার করবে না। আমাদের মুসলমান হিসেবেই সমস্যাকে দেখতে হবে, কেননা, ভারতবর্ষে আমরা হচ্ছি বিশিষ্ট এক কালচার ইউনিট। তবে, সমস্যাকে যেমন মুসলমান হিসাবে দেখতে হবে, তেমনি ভারতবাসী হিসেবেও দেখতে হবে। মুসলমান ভারতবাসীর পক্ষে যা অনিষ্টকর, ভারতবর্ষের হিসেবেও তা অনিষ্টকর। ভারতীয় মুসলমান সমাজের স্বার্থ হচ্ছে ভারতবর্ষের স্বার্থ, আর যা ভারতীয় মুসলমানের স্বার্থের বিরোধী তা ভারতবর্ষের স্বার্থেরও বিরোধী। আমাদের সাহিত্যে, আমাদের মানবতা, আধুনিক পরিভাষায় বিশ্বমানবতা প্রকাশ করবে। সে সাহিত্যে প্রকাশ পাবে মোসলেম কালচারের অনুসারী আমরা, সে সাহিত্যে প্রকাশ পাবে বাঙ্গালা আমাদের মাতৃভাষা, আর বাঙ্গলাদেশ আমাদের মাতৃভূমি। আমাদের সাহিত্যিকদের লেখা থেকে এই তিনটি সত্য সুপ্রকট হয়ে উঠুক। সাহিত্যে দাস মনোবৃত্তি ও পরাজিতের মানসিকতা দূর করে যথেষ্ট সাহসের এবং নতুন আত্মসম্মানপূর্ণ মানসিকতার পরিচয় আমাদের দিতে হবে। যেদিন বঙ্গভাষাভাষী মুসলমানের লেখায় এই রকম আত্মসম্মানের পরিচয় পাবো, সেদিন সত্যই আমাদের মনে আনন্দের হিল্লোল উঠবে। আমাদের বর্তমান মানসিক এবং নৈতিক দুর্দশার জন্য প্রধানত: দায়ী হচ্ছে আমাদের বর্তমান শিক্ষাপ্রণালী। হিন্দু ছাত্র হিন্দুর উপযোগী শিক্ষা পায়, খৃষ্টান ছাত্র খৃষ্টান উপযোগী শিক্ষা পায়, আর মুসলমান ছাত্র খৃষ্টান এবং হিন্দুর উপযোগী শিক্ষা পেয়ে থাকে; মুসলমানের উপযোগী শিক্ষা পায় না। আমাদের ছেলেরা মুসলমানের উপযোগী শিক্ষা যাতে লাভ করতে পারে এবং তা নিয়ে তারা যাতে গৌরব অনুভব করতে শিখে তার আয়োজন করতে হবে। আর বাঙ্গালা ভাষায় মুসলমানের উপযোগী সাহিত্য সৃষ্টি যত শীঘ্র সম্ভব করতে হবে। এই দুইটি কাজ যদি আমরা সুচারুভাবে করতে পারি, তা হলে জাতীয় আদর্শকে তার উপযুক্ত আসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে পারবো।
আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আমাদের সমাজের তরুণ এবং তরুণীদের উপর। আর কারো উপর নয়। তাঁরা যদি জাতীয় সাহিত্য রচনায় তাঁদের কর্তব্য পালন করেন, তাঁরা যদি সমাজকে প্রাণের সঙ্গে ভালবাসেন, তা হলে তাঁদের আন্তরিক সেবায় সব দুঃখ, সব দৈন্য আমাদের কেটে যাবে, আশার এবং আনন্দের গানে জীবন আবার আমাদের মুখরিত হবে।
(জন্ম: বড়জাতপুর, শ্রীরামপুর, হুগলী, ভারত, ১৮৯০ এবং মৃত্যু ১৯৫১)