খেরুয়া মসজিদ বাংলাদেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। মসজিদটি সুলতানী যুগের শেষে, বাংলায় মোঘল শাসনের সূচনালগ্নে বারো ভূঁইয়া এবং বাংলায় অবস্থানরত আফগান প্রধানদের মোঘল বিরোধী বিদ্রোহ চলাকালীন সময়ে নির্মিত। মোঘল-পূর্ব সুলতানী আমলের স্থাপত্যশৈলীর সঙ্গে মোঘল স্থাপত্যশৈলীর সমন্বয়ে এই মসজিদটি নির্মিত হয়েছে।প্রায় ৪৩৫ বছর ধরে টিকে থাকা এই মসজিদটি বগুড়া শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে শেরপুর উপজেলা সদরের খোন্দকার টোলা মহল্লায় অবস্থিত।
প্রাচীন শেরপুর শহরে মোঘল আমলে নির্মিত ৩টি ঐতিহাসিক মসজিদ রয়েছে। যথা-খেরুয়া মসজিদ, বীবী মসজিদ এবং খোন্দকার টোলা মসজিদ। এই তিনটি মসজিদের মধ্যে খেরুয়া মসজিদই সর্বপ্রাচীন, সম্রাট আকবরের আমলে নির্মিত। মসজিদের সামনের দেয়ালে উৎকীর্ণ শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, ১৫৮২ সালে জওহর আলী কাকশালের পুত্র মির্জা মুরাদ খান কাকশাল এটি নির্মাণ করেছিলেন। ‘কাকশাল’ উপাধি ছিল তুর্কিদের দেওয়া। ঘোড়াঘাট অঞ্চল ছিলো তুর্কি জায়গিরদারদের অধীন। শেরপুর সে সময় ঘোড়াঘাটের অধীনে একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল। মির্জা মুরাদ খান কাকশালের বিশদ পরিচয় পাওয়া যায় না, তবে, ঐতিহাসিকদের অনুমান মির্জা মুরাদ খান কাকশাল শেরপুরের জায়গিরদার বা ফৌজদার ছিলেন।
খেরুয়া মসজিদের নামকরণ স্পষ্ট নয়। আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া তার বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ বইতে উল্লেখ করেছেন, ‘এ মসজিদের খেরুয়া নামের কোনো ইতিবৃত্ত পাওয়া যায়নি। আরবি বা ফার্সি ভাষায় খেরুয়া বলে কোনো শব্দ পাওয়া যায় না।’ তবে ফার্সিতে ‘খায়ের গাহ্’ বলে শব্দ আছে। যার অর্থ ‘কোনো স্থানের ভেতরে’। রাজা মানসিংহ যখন বাংলার সুবাদার, তখন তিনি শেরপুরে একটি দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। এই দুর্গের কোনো অস্তিত্ব এখন নেই। তবে মসজিদটি যদি শেরপুর দুর্গের ভেতরে নির্মিত হয়ে থাকে, তবে ‘খায়ের গাহ্’ থেকে খেরুয়া নাম হতে পারে বলে অনুমান করা যায়।
খেরুয়া মসজিদটি টিকে আছে চার কোণের প্রকাণ্ড আকারের মিনার আর চওড়া দেয়ালের কারণে। ইটে খোদাই করা নকশা ক্ষয়ে গেছে এবং চুন-সুরকির প্রলেপ ঝরে গেছে। চুন-সুরকি দিয়ে গাঁথা পাতলা লাল ইটের দেয়ালগুলো ১.৮১ মিটার চওড়া। তার ওপর ভর করেই ছাদের ওপর টিকে আছে খেরুয়া মসজিদের তিনটি গম্বুজ। গম্বুজ তিনটি উপুর করা নকশা বিহীন তিনটি সমান বাটির মত। সুলতানী আমলের গম্বুজের নির্মাণ শৈলীর সঙ্গে এই খেরুয়া মসজিদের গম্বুজের স্টাইলের মিল রয়েছে। খেরুয়া মসজিদ বাইরের দিক থেকে উত্তর-দক্ষিণে লম্বা ১৭.২৭ মিটার, প্রস্থ ৭.৪২ মিটার। পূর্ব দেয়ালে তিনটি খিলান দরজা। মাঝেরটি আকারে বড়। উত্তর-দক্ষিণে একটি করে খিলান দরজা। কোনোটিতেই চৌকাঠ নেই। ফলে দরজার পাল্লা ছিল না। পূর্বের বড় দরজাটির নিচে কালো পাথরের পাটাতন। পূর্বের দরজা বরাবর পশ্চিমের দেয়ালের ভেতরের অংশে তিনটি মেহরাব। মেহরাবগুলোর ওপরের অংশ চমৎকার কারুকাজখচিত। মসজিদটির নিচের অংশে ভূমি পরিকল্পনা মোঘল স্থাপত্যরীতির। ওপরের অংশ মোঘল-পূর্ব সুলতানিরীতিতে। চার কোণে দেয়াল থেকে খানিকটা সামনে চারটি বিশাল মিনার। ছাদের ওপর তিনটি ৩.৭১ মিটার ব্যাসের অর্ধ গোলাকৃতির গম্বুজ। ছাদের কার্ণিশে বাংলার স্থানীয় কুঁড়ে ঘরের স্থাপত্যের ছাপ সুস্পষ্ট এবং যে কারণেই কার্ণিশের দু’ধার সামান্য বাঁকানো। বাংলার কুঁড়ে ঘরের আদলে নির্মিত এমন ছাদ পনের শতকে নির্মিত বাংলার অধিকাংশ স্থাপত্যে লক্ষ্য করা যায়। মসজিদের সামনের দেয়াল প্যানেলিং-এর কাজ করা। এ ধরণের কাজ ঢাকায় অবস্থিত সাত গম্বুজ মসজিদেও লক্ষ্য করা যায়। নান্দনিক বৈচিত্র্য আনা হয়েছে ইটের বিন্যাস ও খাড়া প্যানেল তৈরি করে। সামনের অংশের ইটে আছে ফুল-লতা-পাতা খোদাই করা নকশা। মিনার, গম্বুজ, নকশা ও ইটের বৈচিত্র্যময় গাঁথুনিতে পুরো স্থাপত্যটি অত্যন্ত নান্দনিক হয়ে উঠেছে। মসজিদের সামনে সবুজ ঘাসে ঢাকা আয়তাকার মাঠ। মসজিদের কিনার দিয়ে তাল, নারকেল, আম, কদমগাছের সারি। এক পাশে মৌসুমি ফুলের গাছও আছে। ইটের প্রাচীরের ওপর লোহার রেলিং দিয়ে পুরো চত্বর ঘেরা। মোট জায়গার পরিমাণ প্রায় ৫৯ শতাংশ। নামাজের সময় মুসল্লিরা ছাড়া সাধারণত কেউ ভেতরে প্রবেশ করে না। তাই প্রাঙ্গণটি নিরিবিলি এবং খুবই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। গাছ গাছালিঘেরা সবুজ পরিবেশে তিন গম্বুজওয়ালা প্রাচীন স্থাপত্যটিকে মনোরম দেখায়। প্রাচীন এই মসজিদে নিয়মিত নামাজ আদায় হয়। তাছাড়া প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মসজিদটির সীমানাপ্রাচীর তৈরি করে দেওয়ায় মসজিদের পরিবেশটি ভালো আছে।
বাংলার ইতিহাসে ১৬ শতকের শেষাংশ বারভূঁইয়াদের কর্তৃক মুঘল বিরোধী বিপ্লবের সংকটপূর্ণ সময় হিসেবে চিহ্নিত। তখন শেরপুর মোর্চা ছিল কাকশাল বিদ্রোহীদের শক্ত ঘাঁটি যারা বাংলার বারো ভূঁইয়া ছাড়াও আফগান বিদ্রোহীদের নেতা মাসুম খান কাবুলীর সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছিলেন। বিদ্রোহী সকল দলের কাছে শেরপুর মোর্চা একটি আদর্শ স্থান হিসেবে বিবেচিত ছিল। ফলে তাঁরা সেখানে একটি অস্থায়ী মুসলিম সমাজ
গড়ে তুলেছিলেন এবং খেরুয়া মসজিদটি নতুন গড়ে ওঠে মুসলিম সমাজের প্রয়োজনেই নির্মিত হয়েছিল। রাজনৈতিকভাবে সংকটকালে নির্মিত বলেই মসজিদের নির্মাণশৈলী এবং অলংকরণে অযত্নের ছাপ সুস্পষ্ট। তবে বাংলায় মোঘল পবের্র সূচনা কালের মসজিদ হিসেবে খেরুয়া মসজিদ-এর পৃথক গুরুত্ব রয়েছে। কারণ মসজিদটি তৎকালীন বাংলার রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।
সংকলক: শিফা সাদিয়া



