ইসলামে শায়া’য়ির
এ পৃথিবীর সকল বস্তুরই একটি নাম ও নিদর্শন রয়েছে এবং এ নাম ও নিদর্শনের মধ্যে নিবিড় সম্পর্কও রয়েছে; যা তার পরিচয় বহন করে। সৃষ্টিকর্তার বহু নিদর্শন দুনিয়ায় বিদ্যমান। তেমনিভাবে এ সকল সৃষ্টির নিদর্শনের মধ্যেই তাঁর পরিচয়ের চিহ্ন পাওয়া যায়। ইসলামে শায়া’য়ির হলো আমাদের মুসলিম সত্তা ও পরিচয়কে জাগ্রত রাখা এবং সেই পরিচয়ের ভিত্তিতে জীবনকে পরিচালনা করতে পারা। আরবী শব্দ ‘শুয়ুর’ থেকে শায়া’য়ির শব্দটি উদ্ভুত। যার অর্থ – চিহ্ন, প্রতীক, সিম্বল, নিদর্শন।
মহান আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক প্রেরিত দ্বীন তিনটি বিষয়কে পরিগ্রহ করে –
১. মু’তাকাদাত (معتقدات) তথা ই’তিকাদি বিষয়সমূহ
২. মুকাদ্দাসাত (مقدسات) তথা আমাদের পবিত্র বিষয়সমূহ
৩. শায়া’য়ির তথা সিম্বল, প্রতীক বা নিদর্শনসমূহ
এই তিনটি বিষয় দ্বীনের মৌলিক বিষয়, যা অপরিবর্তনীয়। যেমন- ফিকহি বিভিন্ন বিধান বা বিষয় সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়। কিন্তু এই তিনটি বিষয় অস্পর্শ, যা কখনো পরিবর্তন হয় না।
প্রথমটি , মু’তাকাদাত বা ই’তিকাদকে তিনটি বিষয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। যথা- তাওহীদ, নবুয়ত এবং আখেরাত। প্রেক্ষাপট যতই পরিবর্তন হোক এ বিষয়গুলো অপরিবর্তনীয় থাকবে।
দ্বিতীয়টি হল, মুকাদ্দাসাত। যা পবিত্র বিষয়গুলো বা এমন স্থান ও কাজকে বুঝায়, যা সকল অপবিত্রতা থেকে মুক্ত। মহান আল্লাহ তার কুদ্দুস (قدوس) নামের ভিত্তিতে এগুলো পবিত্র বলে ঘোষণা দেন যার উপর হস্তক্ষেপ করার অধিকার কারো নেই। কিছুক্ষেত্রে শায়া’য়ির ও কুদসিয়াত একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত।
তৃতীয়টি হল, বিভিন্ন সিম্বল বা প্রতীক। শুয়ুর মূল থেকে উদগত হওয়া শায়া’য়ির হল মুসলমান হওয়া এবং মুসলিম হিসেবে বেঁচে থাকার চেতনাকে সর্বদায় জাগ্রত করে রাখার প্রতীকসমূহ। কিছু কিছু স্থান, কিছু কিছু সময় আমাদের দ্বীনের শায়া’য়িরের অন্তর্ভুক্ত।
শায়া’য়ির
শায়া’য়ির ইসলামের ইবাদত সম্পর্কিত, যা ইসলামের অভিন্ন জিনিসের প্রতি ইঙ্গিত করে থাকে। এগুলো ফিকহি বা হুকুমি দৃষ্টিকোণ থেকে ফরজ বা নফল না হলেও সমগ্র মুসলিম জাতিকে সম্পৃক্ত করার কারণে এগুলো ব্যক্তিগত ফরজ থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা কোরআনে দেখতে পাই শায়া’য়ির হজ্জের সাথে সম্পৃক্ত হলেও পরবর্তীতে আরো পরিভাষার সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে।
ইমাম মাতুরিদি শায়া’য়ির সংক্রান্ত আয়াতসমূহ তাফসীর করার সময় “শায়া’য়িরুল্লাহ” (شعائر الله) এই পরিভাষাকে সকল ফরজ বা সামগ্রিক দ্বীনি বিষয়সমূহকে ইঙ্গিত দানকারী বিষয় হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
এভাবে ইমাম ফখরুদ্দীন রাজী শায়া’য়িরকে শুধুমাত্র কিছু বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে আল্লাহর সকল ইবাদাতের সাথে সম্পৃক্ত করে বর্ণনা করেন।
অনুরূপভাবে ইমাম দেহলভি শায়া’য়িরের সীমানাকে আরো বিস্তৃতভাবে উল্লেখ করেন।
শায়া’য়িরের প্রতি সম্মান
আল্লাহর ইবাদতের পাশাপাশি আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার জন্য যেসকল আবেগ অনুভূতি গুরুত্বপূর্ণ তাও তিনি শায়া’য়ির এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। যেমন- কোরআনে দেখতে পাই, যে ব্যাক্তি শায়া’য়িরের প্রতি সম্মানজনক আচরণ করবে তা হবে তার তাকওয়াপূর্ন কলবের পরিচয়। সূরা মায়েদার ২ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে,
“হে ঈমানদারগণ, আল্লাহর আনুগত্য ও ভক্তির নিদর্শনগুলোর অমর্যাদা করো না। হারাম মাসগুলোর কোনোটিকে হালাল আবার কোনোটিকে হারাম বলো না, কোরবানির পশুর উপর হস্তক্ষেপ করো না। যেসব পশু আল্লাহর জন্য উৎসর্গিত আলামতস্বরুপ পট্টি বাধা থাকে, তাদের উপরও হস্তক্ষেপ করো না। আর যারা রবের অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টির জন্য কা’বার দিকে যাচ্ছে, তাদেরকে উত্যক্ত করো না। আর হারামের বা ইহরামের অবস্থা শেষ হয়ে গেলে অবশ্যই শিকার করতে পারো। একটি দল তোমাদের জন্য মসজিদুল হারামের পথ বন্ধ করে দিয়েছে। তোমাদের ক্রোধ যাতে তোমাদেরকে এতোখানি উত্তেজিত না করে যে তাদের বিরুদ্ধে অবৈধ বাড়াবাড়ি শুরু করো। নেকি ও আল্লাহভীতির সমস্তকাজে সবাইকে সহোযোগিতা করো এবং গুনাহ ও সীমালঙ্ঘন এর ব্যাপারে সাহায্য করো না। আল্লাহকে ভয় করো। তার শাস্তি বড়ই কঠোর।”
এ আয়াত থেকে বুঝা যায়, সবচেয়ে বড় শায়া’য়ির হচ্ছে কোরআন, নামাজ, কাবা, হযরত পয়গম্বর (সা.)। এ চারটি বিষয়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা মানে আল্লাহর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। আর এগুলোকে অসম্মান করা মানে আল্লাহকে অসম্মান করা। “হাকদিলি কোরআন”-এর লেখক প্রখ্যাত মুফাসসির ইলমালুল হামদি ইয়াজির বলেন, “শায়া’য়িরকে ইবাদতের সাথে সম্পৃক্ত করা যায় বা যেসকল স্থানে ইবাদত করা হয় তাও সম্পৃক্ত করা যায়।” তার কথার আলোকে তাওয়াফ করা, সাঈ করা, ইহরাম বাধার পাশাপাশি আজান, জামায়াতে নামাজ, ঈদের নামাজ, জুমার নামাজ, মসজিদসমুহ, মসজিদের মিনারসমুহ, হিজাব, পরস্পরের প্রতি সালাম দেয়া শায়া’য়ির এর অন্তর্ভুক্ত।
কোনো অঞ্চলে ইসলাম আছে এটা বুঝার জন্য যত ধরনের ধর্মীয় আদেশ আছে সুন্নত হোক বা ফরজ হোক তা শায়া’য়ির এর অন্তর্ভুক্ত। শায়া’য়ির এর প্রথম বিষয় হচ্ছে নামাজ। রাসুল (স.) বলেছেন, “নামাজ দ্বীনের স্তম্ভ”। আমরা ঈমানের চাইতেও নামাজের ক্ষেত্রে শায়া’য়ির বেশি দেখতে পাই। যেমন- নামাজে রুকু, সিজদাহ, হাত বাধা। এগুলো আমরা নিজের ইচ্ছেমতো করতে পারবো না। এগুলো একটি নিয়ম যা শায়া’য়ির এর অন্তর্ভুক্ত।
নামাজের মধ্যে তিন ধরনের শারীরিক কাজ রয়েছে। কিয়াম বা পায়ের উপর দাড়ানো, রুকু বা মেরুদণ্ড বাঁকানো, এবং সিজদাহ্ বা কপাল মাটিতে স্পর্শ করা। আবার আমরা যখন চাই তখনই নামাজ পড়তে পারবো না। নামাজের নির্দিষ্ট ওয়াক্ত আছে এবং নামাজের জন্য অযু বা পবিত্রতা দরকার যা শুধু বাহ্যিক পবিত্রতা নয়। আমাদের অভ্যন্তরীণ পবিত্রতা যা তাওবার প্রতি ইঙ্গিত করে।
অযুতে আমরা শরীরের প্রায় সকল অঙ্গ ধুই। যেমন- অযুর শুরুতে হাত ধুয়ে থাকি, এর মাধ্যমে হাতের দ্বারা করা সকল খারাপ কাজের তাওবা হয়। কুলি করি, নাকে পানি দেই, এর মাধ্যমে হারাম কিছু খেলে বা ঘ্রাণ নিলে এগুলোও তওবার দিকে ধাবিত করে এবং হারাম থেকে বিরত থাকতে শিখায়। আবার মুখ ধোয়ার সময় চোখ ধুই, যাতে চোখের দ্বারা যেসব খারাপ কাজ করা হয়, তা থেকে অবচেতন মনে বিরত থাকি। আমরা মাথা মাসেহ করি যার মাধ্যমে আমরা মাথায় খারাপ চিন্তা আসা থেকে বিরত রাখি। কান মাসেহ করার মাধ্যমে খারাপ কিছু শোনা থেকে বিরত থাকি। সবশেষে পা ধুই, যার মাধ্যমে আমরা খারাপ কাজে পা বাড়ানো থেকে বিরত থাকি। তাই এ অযুর মাধ্যমে আমরা বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ দুই ধরনের পবিত্রতা অর্জন করি।
মুহাম্মদ হামিদুল্লাহ অযুর এসব বিষয়কে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, অযুর মাধ্যমে আমরা সংকল্প করি যাতে এসব কাজের পুনরাবৃত্তি না করি। তিনি নামাজের মধ্যে কিয়াম এবং সিজদাহকে প্রকৃতির সাথে সম্পৃক্ত করে একটা কথা বলেন। পৃথিবীতে তিন ধরনের জগৎ আছে। যেমন-
১.বৃক্ষলতা
২.পশুপাখি
৩. জড়বস্তু অর্থাৎ যে সকল সৃষ্টিকে আমরা প্রাণহীন বলে জেনে থাকি। যেমন- পাহাড়।
পাহাড় পর্বত সবসময় দন্ডায়মান। তারা এভাবেই আল্লাহর আদেশ মানে এবং সেবা করে থাকে। একজন মুসলিম যখন নামাজ শুরু করে তখন এসকল পাহাড়ের মতো সকল কিছু থেকে মুক্ত থেকে পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকে। একইভাবে চার পা ওয়ালা পশুগুলো সবসময় রুকুর মতো থাকে। মুসলমানগন রুকু করার মধ্যদিয়ে আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধা বা ভক্তির প্রকাশ করে থাকে। একইভাবে যেসকল বৃক্ষ বা তৃণলতা যাদের মুখ মাটিতে এবং তারা এভাবে খাদ্য গ্রহণ করে আল্লাহর সিজদাহ করে। সিজদাহ আমাদেরকে মনে করায় আমরা এই জমিন থেকেই এসেছি আমাদের এখানেই যেতে হবে।
ইসলামের আরেকটি শায়া’য়ির হচ্ছে যাকাত। কুরআনে প্রায় ২০ টি আয়াতে নামাজ এবং যাকাতের কথা একত্রে এসেছে। এ বিষয়টি আমাদেরকে শেখায় কীভাবে একটি দ্বীনি ব্যবস্থাপনা সামগ্রিক বিষয়কে পরিগ্রহ করে থাকে। নামাজ আদায়ের সময় আমরা শরীরকে পবিত্র করে থাকি এবং যাকাতের মাধ্যমে রুহকে পবিত্র করে থাকি। তাই এ আয়াতসমূহের মাধ্যমে শরীর এবং রূহকে একত্রে পবিত্র করার কথা বলা হয়েছে। কোরআনে শায়া’য়ির সম্পর্কিত কথা বলতে সবচেয়ে বেশি হজ্জের কথা বলা হয়েছ। হজ্জের মধ্যে যত ইবাদত আছে এগুলোকে যারা সম্মান করবে তারা আল্লাহকে সম্মান করবে এমন বলা হয়েছে। সূরা বাকারার ১৫৮ এবং সূরা হজ্জের ৩৬ নাম্বার আয়াতে শায়া’য়িরের এ সকল বিষয় সম্পর্কে বলা হয়েছে।
হজ্জ এমন একটি ইবাদত যা স্বয়ং নিজেই ইসলামের বড় একটা প্রতীক। ওমরাহ করার আগে আমরা ইহরাম পরিধান করি, যা বড় একটি নিদর্শনস্বরুপ। ইহরাম দ্বারা বোঝায় আল্লাহর সামনে আমরা সকলেই সমান। ধন-সম্পদ, সামাজিক অবস্থান এগুলো আল্লাহর কাছে কোনো তফাত নেই। সবাই আল্লাহর কাছে সমান। ইহরামের বিষয় বিশেষভাবে পুরুষদের সাথে সম্পৃক্ত। কারণ রাসূল (স.) বলেছেন, নারীরা যা পরিহিত থাকবে তাই তার জন্য ইহরাম। অন্যদিকে পুরুষরা সকল কিছু ত্যাগ করে শুধুমাত্র দুটি কাপড় পরিধান দিয়ে সবার মতো একই পোশাকে একইভাবে ইহরাম বাঁধে। এটা অনেক বড় একটা শায়া’য়ির। তবে, হজ্জের সবচেয়ে বড় শায়া’য়ির হলো বায়তুল্লাহ বা কা’বা। কা’বা শব্দ কোরআনে দুইবার আসলেও বায়তুল আতিক, বায়তুল হারাম এধরনের শব্দের মাধ্যমে বহুবার এসেছে। কা’বা হচ্ছে মহান আল্লাহর একত্বকে প্রকাশকারী পৃথিবীতে স্থাপিত প্রথম ইবাদতের গৃহ।
কালো ঘরটি ছড়াও হাজরে আসওয়াদ এবং আরো অনেক জিনিস কা’বার অন্তর্ভুক্ত। আমরা হজ্জে গেলে হাজরে আসওয়াদকে সালাম প্রদান করি যা আমরা রূহের জগতে আল্লাহকে কথা দিয়ে এসেছিলাম। হাজরে আসওয়াদ সাধারণ একটা কালো পাথরের মতোই, কিন্তু আল্লাহ এটার সাথে পবিত্রতা সম্পৃক্ত করার কারণে এটা আমাদের জন্য পবিত্র। একদিন হযরত ওমর রা: কাবার পাশে দাঁড়িয়ে হাজরে আসওয়াদকে বলছিলেন, “তোমার দ্বারা কোনো কল্যাণ বা অকল্যাণ নেই, কিন্তু হযরত মোহাম্মদ (স.) তোমাকে চুম্বন করেছেন এবং সালাম জানিয়েছেন তাই আমিও তোমাকে চুম্বন করি এবং সালাম দেই।”
এরপর আছে মাকামে ইব্রাহিম যা কাবার পাশেই যার উপর ইব্রাহিম (আ:) দাঁড়িয়ে কা’বা নির্মাণ করেছিলেন। আমরা এটাকেও সালাম জানাই, কারণ এটিও শায়া’য়ির এর অন্তর্ভুক্ত। এরপর কা’বার সাথেই একটা জায়গা বাঁকা চাঁদের মতো – হাজরে ইসমাইল, যেখানে ইসমাইল আ: লালিত পালিত হয়েছিলেন। অনেক জায়গায় বলা হয়ে থাকে – হাজেরা (আ.) কে তার মৃত্যুর পর আল্লাহর ইশারায় ওখানেই দাফন করা হয়। আবার অনেকে বলেন ইসমাইল (আ.) কেও ওখানে দাফন করা হয়, যদিও এটা ততটা গ্রহণযোগ্য নয়। হযরত হাজেরা একজন কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসী ছিলেন। কিন্তু আল্লাহ তাকে সম্মানিত করেছেন যার কারণে আমরা তাকে সালাম জানাই। আল্লাহ তায়ালা তার সাদাকাত ও কর্মের জন্য সমগ্র নারী জাতির জন্য তাকে উপমা হিসেবে তুলে ধরেছেন।
তিনি যখন ক্রীতদাসী ছিলেন এ অবস্থায় একজন পয়গম্বরের স্ত্রী এবং একজনের মা হয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে মুহাম্মদ (স.) এর দাদী হয়েছিলেন। তার আন্তরিকতা বা ইখলাসের কারণে আল্লাহ তাকে এত সম্মানিত করেছেন। এমনকি ঐদিন থেকে এখন পর্যন্ত ওনাকে যেখানে দাফন করা হয়েছে, সেই হাজরে ইসমাইলের কাছে সবাই দুই রাকাত নামাজ পড়ার জন্য প্রতিযোগিতা করে।
সূরা বাকারার ১৫৮ আয়াতে বলা হয়েছে
“সাফা এবং মারওয়া হচ্ছে শায়া’য়ির এর অন্তর্ভুক্ত। যারা হজ্জ এবং ওমরাহ করবে এগুলোকে তাওয়াফ করবে। কেউ যদি নিজের ইচ্ছায় ভালো কাজ করে তাহলে সে আল্লাহর নিকটে পুরস্কার পাবে।”
হজ্জের মধ্যে সাঈ দ্বারা হযরত হাজেরা (আ.) এর ত্যাগের প্রতি সম্মান জানানো হয়। একইভাবে সাঈকারী প্রতিটি মুসলিম নারী এবং পুরুষ সাঈ করার সময় হাজেরা (আ.) যে সকল সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন সে দৃশ্যটি মনে চিত্রায়িত করেন। সেখানে তিনি হযরত ইসমাইল (আ) পানি পান করানোর জন্য সাতবার সাফা মারওয়ায় উঠেছিলেন। ঐ বিষয়টিকে প্রতীক হিসেবে সাঈ করা হয়। তিনি বসে থাকেননি বরং চেষ্টা করেছেন। আর এর ফলস্বরূপ আল্লাহ তাদেরকে জমজম দান করেন। জমজম আমাদের জন্য অনেক মূল্যবান একটা মুজিযা।
আমরা হজ্জে গেলে হজ্জের রোকন জানতে চাই। আমার মতে এর সাথেসাথে ইব্রাহিম (আ.) এবং হাজেরা (আ.) এর সংগ্রাম সম্পর্কেও আমাদের জানা উচিত। তাহলে আমরা হজ্জের রূহ সম্পর্কে জানতে পারবো, যা আমাদের জীবনে প্রভাব ফেলবে। হযরত হাজেরার ইখলাস সম্পর্কে জানতে তার ব্যাপারে বেশি বেশি পড়া উচিত। তাহলে আমরাও আমাদের জীবনে জাতির জন্য ভালো কিছু করার প্রভাব ফেলতে পারবো।
আরও অন্যান্য কিছু শায়া’য়ির আছে যেগুলো জায়গা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। আমরা দেখতে পাই মুযদালিফায় অবস্থান করা, লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক বলা, শয়তানকে পাথর মারা ইবরাহীম (আ) এর স্মৃতি। পাথর নিক্ষেপ শয়তানের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থানকে দৃঢ় করার প্রতীক। একইভাবে একজন মুসলমান হজ্জে যাওয়ার পর আরাফাতে অবস্থান করে। এটাও হযরত আদম (আ) এবং হাওয়া (আ) এর মিলিত হওয়ার মাধ্যমে তাদের পর্যন্ত বিস্তৃত।
একজন মুসলিম হজ্জের সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে কুরবানি করেন। কুরবানিও অনেক বড় একটা শায়া’য়ির। হযরত ইব্রাহিম (আ) তুরস্ক থেকে মিশর যান, তারপর ফিলিস্তিন যান এবং দ্বীনের দাওয়াত দেন। কিন্তু কেউ তার দাওয়াত গ্রহণ করেনি। তাই তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করেন যাতে তাকে এমন একটা সন্তান দেন যাকে সাথে নিয়ে দ্বীনের কাজে অগ্রসর হতে পারবেন।
আল্লাহ এই দোয়ার ফলস্বরূপ ইসমাইল (আ.) কে সন্তান হিসেবে দেন। এরপর আরেক সন্তান দেন ইসহাক (আ.)। পরবর্তীতে তাদের বংশতেই নবী-রাসূলদের আগমন ঘটে। তাই দেখা যায়, সকল পয়গম্বরই ইব্রাহীম (আ.) এর দোয়ার প্রতিফল। এই হাকীকতকে হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন, আমি আমার দাদা ইব্রাহিম আ: এর দোয়ার প্রতিফল। আমরাও এই দোয়াকে স্মরণ করে আল্লাহকে স্মরণ করে জিলহজ্ব মাসের ১০ তারিখে কুরবানি পালন করি। সূরা হজ্জের ৩৬ নাম্বার আয়াতে অনুসারে কুরবান হচ্ছে মহান আল্লাহর প্রতি এবং হক ও হাকীকতের প্রতি ভালো কল্যাণ ও সত্যের প্রতি আমাদের যে অনুসন্ধান এবং আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়া। কুরবানির সকল কিছুই আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার জন্য। কোরআনে বলা হয়েছে, তোমরা যে পশু কুরবানি করো তার রক্ত মাংস আল্লাহর কাছ পৌঁছে না, বরং তোমাদের নিয়ত আল্লাহর কাছে পৌছে।
কুরবানিকে ভালোভাবে পালন করলে আমাদের মানবতার উন্নতি হয়। নিজেদের প্রতি প্রতিবেশীদের প্রতি দায়িত্ববোধ জাগ্রত করে। একে অপরের সাথে শরিক হওয়ার বিষয় জাগ্রত করে থাকে। একে অপরের সাথে সম্পর্ক বিনির্মাণের উছিলা হয়ে থাকে। কুরবানির মানে হচ্ছে, যে যুগে একজন আরেকজনকে মেরে ফেলছে সেখানে ভ্রাতৃত্বের নিদর্শন তৈরি করা। এই বিষয়টি তখনই সম্ভব যখন ইবাদতের রূহ নিজের মধ্যে বিকশিত করতে পারবো। এই রূহকে ভুলে না গিয়ে জীবনেকে আখলাকের মাধ্যমে সুসজ্জিত করতে পারবো। এটি তখনই অর্জন হবে যখন সকল ইবাদাত সঠিকভাবে পালন হবে।
এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা দ্বীনের অর্ধেক। রাসুলের (সা.) এ কথা স্মরণ করে পরিবেশের ক্ষতি না করে এ ইবাদত করতে হবে। এই কারণে জবেহকৃত প্রতিটি কুরবান সেখান থেকে প্রবাহিত প্রতিটি রক্তের ফোঁটা শতশত বছর ধরে আমাদের অস্তিত্বের জন্য যারা ত্যাগ স্বীকার দিয়েছে তাদেরকে স্মরণ করে। আমাদের জীবনকে তাদের চরিত্রের আলোকে সুসজ্জিত করতে পারলে তখন আমাদের ইবাদত অর্থবহুল হবে এবং ইবাদতের রুহ আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন হবে। যেকোনো মুল্যে কুরবানির শিক্ষা নিয়ে মুসলিম বিশ্বে রক্তপাত বন্ধে সক্রিয় ভুমিকা পালন করতে হবে। ইসলামী সভ্যতাকে যেন আমরা পুনরায় মানবসভ্যতার কেন্দ্রে স্থাপন করতে পারি। এই রূহ যেনো আমাদেরকে ইবাদাতসমূহ অর্জনের দিকে ধাবিত করে। আমিন।
অনুবাদঃ বুরহান উদ্দিন আজাদ