আধুনিক সময়ে মানব সভ্যতা সবচেয়ে বড় সংকট হলো আখলাকী সংকট। আজ বিশ্বব্যাপী যে আখলাকী সংকট এটা মূলত অর্থবহতার সংকট। কিংবা আখলাকহীনতার যে সংকট এটা হলো মূলত অর্থহীনতা থেকে সৃষ্ট। বিশ্বব্যাপী আখলাকী সংকটের মূল কারণ হলো মহাবিশ্ব, মানুষ, সৃষ্টিজগতের অর্থ ও এসকল সৃষ্টির উদ্দেশ্যকে হারিয়ে ফেলা। সকল কিছুর মূল্যমান (Value) ও সম্মানকে হারিয়ে ফেলা। তবে আখলাক স্বয়ং নিজেই একটি অর্থ। অর্থবহতা ও আখলাকের এই সংকট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য অনেকেই প্রচেষ্টা চালিয়েছে।
অর্থবহতার এই সংকট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মানবতা এত বেশি দর্শনের সৃষ্টি করেছে মানব ইতিহাসে যার তুলনা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। অসংখ্য থিওরি ও চিন্তা তৈরি করেছে, লাইব্রেরি ভর্তি গ্রন্থ রচনা করেছে কিন্তু অর্থবহতার সংকটকে অতিক্রম করতে পারেনি। এই সংকট থেকে মুক্তি পেতে যেই প্রশ্নটি সঙ্গত কারণে আসে, মানুষকে কেন সৃষ্টি করা হয়েছে? এর হাকীকত কী?
মানুষকে শুধুমাত্র ইবাদত করার জন্য তৈরি করা হয়নি। ইবাদত শুধুমাত্র মারসুমার মাধ্যমে নয় বরং আখলাককে পরিগ্রহকারী বন্দেগীর মাধ্যমেও সম্ভব।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষকে তাঁর নিজের খলীফা হিসেবে সৃষ্টি করেছেন এবং ইসতিখলাফ নামে একটি দায়িত্বও প্রদান করেছেন।
ইসতিখলাফ হলো এমন একটি দায়িত্ব যেটা সকল মু’মিনকে মহান আল্লাহ দিয়েছেন সমগ্র দুনিয়াতে হক্ব ও আদালত প্রতিষ্ঠা করার জন্য।
এই দায়িত্ব মু’মিনদেরকে ব্যক্তিগতভাবে যেমন দেওয়া হয়েছে, তেমনি উম্মত হিসেবেও দেওয়া হয়েছে।
আখলাক খুঁজে পাওয়ার জন্য মূল্যবোধকে সংজ্ঞায়িত করা প্রয়োজন। আর মূল্যবোধসমূহকে জানার জন্য মূল্যবোধের উৎস নির্ণয় করা আবশ্যক। একজন মানুষের রূহকে শরীরের আগে সৃষ্টি করা হয়েছে। ইসলাম মতে, মানুষ আখলাক ও মূল্যবোধের মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে প্রেরিত হয়ে থাকে। একজন শিশু জন্মগত ভাবে কিছু গুণাবলী অর্জন করে থাকে। এই গুণাবলীকে ফিতরাত বলা হয়ে থাকে।
এই ফিতরাতকে যখন মানুষ পরিণত বয়সে আচরণে রূপ দেয় তখন তাকে আখলাক বলে। এই আখলাকের কারনেই মানুষ অন্যায়কে অন্যায় বলতে পারে, জুলুমকে জুলুম হিসেবে চিহ্নিত করে থাকে।
বর্তমান সময়ে আমরা জুলুমকে শুধুমাত্র জুলুম বলতে পারি না বা জুলুম বন্ধ করারক্ষেত্রেও পদক্ষেপ নিতে নেই না। বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বড় উদাহরন হচ্ছে গাজার মানুষদের উপর হামলা। এর কারন হলো- বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বড় সংকটগুলোর মধ্যে একটি হলো আখলাকী সংকট। মানব সৃষ্টির পিছনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের তিনটি বড় উদ্দেশ্য হচ্ছে-
১. ইবাদত
২. ইসতিখলাফ
৩. ইমারত
ইসতিখলাফ হচ্ছে এমন একটি দায়িত্ব এর মাধ্যমে মানুষ সমগ্র দুনিয়াতে হক ও আদালত প্রতিষ্ঠা করবে।
উপরোক্ত তিনটি বিষয়ই আখলাকের অন্তর্ভুক্ত।
আল্লাহ তায়ালা মানুষ সৃষ্টির অন্যতম একটি উদ্দেশ্য হলো আখলাক বিনিমার্ণ করবে। কিন্তু বর্তমানে আমরা যে যুগে বসবাস করছি সেটা হচ্ছে বিশ্বায়নের যুগ। যেখানে মানুষ নিজেদের জন্য আলাদা ডিজিটাল যুগ তৈরি করে নিয়েছ। এ যুগকে এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে করে মানুষ ভুলে থাকে।
মুসলিম হিসেবে নিজের কল্যাণ করে নিজেকে হাকীকী মুসলিম হিসেবে দাবি করি। কিন্তু সমগ্র মানবতার জন্য যে দায়িত্ব ও কর্তব্য সেখান থেকে আমাদের মধ্য থেকে ইসতিখলাফ থাকে না।
মুসলিম হিসেবে খিলাফতের দায়িত্ব দায়িত্ব পালন করার অর্থ হচ্ছে আদালত ও হক বয়ে নিয়ে যাওয়া। এবং আখলাকের সৌন্দর্য ছড়িয়ে দেওয়া।
ইসলামি সভ্যতায় ইসলাম প্রচারে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীরা যেখানেই যেতেন তাদের আচরণে আখলাকী প্রভাব স্থান পেত। কারন তারা হালাল ও আখলাককে বহন করতেন।
বর্তমান সংকটকালীন মুহূর্তে পৃথিবীকে কীভাবে বিনির্মাণ করবো? আল ফারাবী তার বিখ্যাত গ্রন্থ আল-মাদীনাতুল ফাদিলাতে ফাজিলতপূর্ন শহরের ফিলোসফি দাঁড় করান। তিনি বলেন, মুমিনের উচিত হবে সর্বপ্রথম ক্বলবকে বিনির্মাণ করা। এরপর দুনিয়াকে বিনির্মাণ করা। কেননা, মানুষ বিনিমার্ণ (ইমার) করা ছাড়া পৃথিবী বিনির্মাণ সম্ভব না।
ইসলামে আখলাক শুধুমাত্র আচরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ না একইসাথে এটি আধ্যাত্মিকতার সাথে ও সম্পৃক্ত। আখলাক একইসাথে সৃষ্টিজগত সম্পর্কিত একটি ফিলোসোফি। বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী আখলাকী সংকটের কারন হলো সকল কিছুকে আধ্যাত্মিক অস্তিত্ব ছাড়া মানুষের বস্তুগত অস্তিত্বকে বুঝার চেষ্টা করা।
আজ বিশ্বব্যাপী যে সংকট তা হচ্ছে অর্থবহতার সংকট। মহাবিশ্ব, মানুষ, সৃষ্টিজগতের অর্থ ও উদ্দেশ্যকে হারিয়ে ফেলেছে।
আখলাকী সংকট থেকে উত্তরণের জন্য এথিক্সের ফিল্ডে লিটারেচর সহ অসংখ্য থিওরি গড়ে উঠে। এসকল থিওরিতে দেখতে পাই, আল্লাহকে বাদ দিয়ে মানুষকে কেন্দ্রে স্থাপন করে বরং সেকুলার আখলাক গড়ে উঠে। আর বর্তমানে সেকুলার আখলাক সংকট সৃষ্টির কারন হয়ে দাঁড়িয়েছ।
আখলাককে খুঁজে পেতে মূল্যবোধকে সংজ্ঞায়িত করা প্রয়োজন এবং মূল্যবোধের উৎস নির্ণয় করা প্রয়োজন। মুসলিমরা কেন আজ এই সংকটে তার আরো বেশ কয়েকটি কারণ হচ্ছে, দ্বীন ও আখলাকের মধ্যকার সম্পর্কের মধ্যে সমস্যা রয়েছে। মুসলমানদের নাজারী ও আমলী দৃষ্টিকোণ থেকেও আখলাকী সংকট বিদ্যমান।
আমাদের দায়িত্ব জ্ঞানকে আখলাক ও হিকমতের সমানুপাতিক হিসেবে রাখা। আধুনিক এ সভ্যতায় জ্ঞান শুধুমাত্র তথ্যের সেক্টর হিসেবে পরিণত হয়েছে। বর্তমান দুনিয়ায় ‘জ্ঞানের আখলাক’ এবং জ্ঞান ও মানুষের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে চিন্তা করা জরুরী হয়ে পড়েছে।
‘আদালত’ পরিভাষাটি কেবল মানুষ ও সমাজের সাথে নয় একই সাথে বিশ্বজগৎ ও সৃষ্টিতত্ত্বের সাথে সম্পৃক্ত একটি পরিভাষা। আদালত প্রতিষ্ঠা করতে হলে আখলাকের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে হবে। যেখানে আদালত প্রতিষ্ঠা থাকে না সেখানে ইসলাম আমানত হিসেবে নিজে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে মাত্র। আদালত প্রতিষ্ঠিত না থাকলে ইসলামের সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
বর্তমান যুগ সম্পন্ন ডিজিটালাইজড হওয়ার কারনে মানুষজন ভার্চুয়াল জগতের উপর নির্ভরশীল। গণমাধ্যম থেকে শুরু করে শিক্ষাগ্রহণ সম্পন্ন সময়টি ডিজিটাল মাধ্যমে হয়ে থাকে। একদিকে সভ্যতাগত তথ্যগুলো সহজ করে তুলে ধরেছে। অন্যদিকে সকলের চিন্তার জায়গাকে দূর্বল করে তুলেছে। সব কিছুর ক্ষেত্রেই আমরা অনলাইন নির্ভরশীল হয়ে যাই।
দৈনন্দিন জীবনের কাজকর্ম হতে শুরু করে ধর্মীয় বিষয়াদী, বিশ্বের খবরাখবর সব কিছু ডিজিটাল মাধ্যমে দেখা যেমন সহজতর করে তুলেছে অন্যদিকে তেমনি আমাদের নিরব দর্শকে পরিণত করে দিয়েছে। অধিকাংশ সময় মানুষ নিজের অনুভব, আকল ও ক্বলবের সীমানাকে সংকীর্ণ করে দিয়েছে।
এই সংকীর্ণতার মাধ্যমে মানুষ যেমন তার রবকে জানতে পারে না একই সাথে আশেপাশের পরিবেশে ও পরিস্থিতির সাথেও সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে না। বর্তমান স্ক্রিন সভ্যতায় তৈরিকৃত দুনিয়ায় আখলাকহীন ও অমানবিক ভাবে মানুষের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে, এমনকি মানুষের স্বপ্ন-কল্পনা এর মাধ্যমে পরিচালিত হয় বিভিন্ন মিডিয়া, গন মাধ্যম, সিনেমা ইত্যাদির মাধ্যমে। ভিজ্যুয়াল এই দুনিয়া আমাকে চাকচিক্যয়ময়তা দেখিয়ে মানুষের ভিতরকার বস্তুগত দিক বাহির থেকে জীবন্ত দেখিয়ে থাকলেও আধ্যাত্মিক অস্তিত্বকে মৃত করে দিচ্ছে। আকল ও ক্বলবের সীমারেখা সংকীর্ন করে বর্তমান দুনিয়ায় মানুষ সব বিষয় জানতে গিয়ে স্ক্রিনেই সময় ব্যয় করছে।
এসকল দিক বিবেচনায় রেখে আমাদের সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করতে হবে। আমাদের উচিত বিশ্বব্যাপী আখলাকী সংকট থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের আকল, ক্বলব এবং রূহকে সময়ের এই গতিধারায় জাগতিক ও আধ্যাত্নিক জীবনধারায় রূপান্তরের জন্য আখলাক চর্চা করা। তাহলেই আমরা স্ক্রিন সভ্যতার যুগে নিজেদের আবারো পুনরুজ্জীবিত করতে পারবো।